রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর। আমার জীবনের এক যুগের স্বর্গ, স্বপ্নোদ্যান।
_________
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
বহু- বহু দূরে একটি মেয়ে,
সর্বাঙ্গে সূর্যের সোনালি আলো মেখে
পেঁজা তুলোয় সজ্জিত নীল আকাশের দিকে
তাকিয়ে বলছে-
"হে ঈশ্বর, আমি স্কুল যেতে চাই" —
সেই হাত দুটি সে বাড়িয়ে ধরেছে
স্বর্গের দিকে,
যে হাতে তার খাতা পেন থাকার কথা —
বহু- বহু দূরে একটি মেয়ে,
সর্বাঙ্গে সূর্যের সোনালি আলো মেখে
পেঁজা তুলোয় সজ্জিত নীল আকাশের দিকে
তাকিয়ে বলছে-
"হে ঈশ্বর, আমি স্কুল যেতে চাই" —
সেই হাত দুটি সে বাড়িয়ে ধরেছে
স্বর্গের দিকে,
যে হাতে তার খাতা পেন থাকার কথা —
তোমার কি মনে পড়ে
সেই মেয়েটির কথা ––
যে একদিন ছুটে বেড়িয়েছে তোমার প্রাঙ্গণে,
যার পা দুটি লাফিয়ে উঠেছে তোমার সিঁড়িতে,
যার হাত দুটি মুঠোয় মুঠোয় কুড়িয়েছে
তোমার গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল,
যার চোখ দুটি গোগ্রাসে গিলেছে
তোমার ব্ল্যাকবোর্ডে ফুটে ওঠা সাদা হরফগুলো —
তোমার কি মনে পড়ে
সেই দিনটির কথা
যেদিন সে তোমার বিরাট হলঘরে দাঁড়িয়ে
শিক্ষিকাদের মুখে শুনেছে নিজের নাম,
উঠে দাঁড়িয়েছে বিরাট সেই স্টেজে,
কিংবা সেই দিন
যেদিন সে তোমার প্রাঙ্গণ থেকে
হাসতে হাসতে
বন্ধুদের হাত ধরে শিক্ষিকাদের অনুসরণ করেছে
শহরের কোন এক দর্শনীয় স্থানের দিকে —
সে গান গেয়েছে তোমার করিডরে দাঁড়িয়ে,
সে মডেল বানিয়েছে তোমার লাইব্রেরিতে বসে,
সে নেচেছে তোমার বিরাট সেই হলে,
ছোট্ট দুটি হাতে ঘুরিয়েছে রঙিন পাখা —
যে রুমে বসে সে পোস্টার এঁকেছে একদিন,
তা আজ শূন্য, শূন্য, শূন্য —
যে বেঞ্চে বসে সে বই-খাতা উল্টেছে,
তা আজ কয়েক ইঞ্চি ধুলোর স্তরে ঢাকা,
যে ডাস্টবিন সে বানিয়েছিল তার বন্ধুদের সাথে,
সেখানে কোথায় তাদের ছেঁড়া কাগজ,
কোথায় তাদের চকোলেট- বিস্কুটের প্যাকেট,
রঙিন আর্টপেপার আর চুমকিতে মোড়া বাক্সগুলোর
একমাত্র বস্তু আজ মাকড়সার জাল!
সেদিন ছিল এক বসন্তের বিকেল,
সূর্যের সোনার রেণু ছড়িয়ে যাচ্ছিল গাছের সবুজ পাতায়,
দখিন হাওয়ায় কাঁপছিল জানালার পাল্লাগুলো,
সে সেদিন তোমার কোলে দাঁড়িয়ে
নীলকান্তমণির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে
ভাবছিল, একদিন সে উজ্জ্বল আলোয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে
পুরস্কার নেবে প্রধান শিক্ষিকার হাত থেকে
আর খবরের কাগজে জ্বলজ্বল করবে তার স্কুলের নাম —
হায়, কোথায় তার সে স্বপ্ন, সে ইচ্ছা,
সব আশা তার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ধুলোয় —
এক ফোঁটা চোখের জল শুধু
আঁকা রইল চকের গুঁড়োয় সাদা ব্ল্যাকবোর্ডে।
না, সে তোমার ওপর রাগ করে না।
সে জানে,
অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সে জানে,
তুমিই তাকে শিখিয়েছ স্বপ্ন দেখতে,
বুঝিয়েছ জীবনের প্রকৃত মূল্য,
তোমার ছত্রছায়াতেই সে শিখেছে,
শিক্ষা কেবল পরীক্ষার খাতায় আবদ্ধ নয়,
তা পৃথিবীটাকে গড়ে তোলে আরও সুন্দরভাবে,
মুছে দেয় সমস্ত হিংসা, সমস্ত কলঙ্ক,
একরাশ ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় প্রতিটি জীবকে।
সে কাউকে দোষ দেয় না,
শুধু অভিশাপ দেয় সেই ছোট্ট বস্তুটাকে,
সেই ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রতম বস্তুটাকে,
যাকে কেউ চোখে দেখতে পায় না,
স্পর্শ করতে পারে না,
শুধু কাপড়ের টুকরোয় নাকমুখ ঢেকে
আর ঝাঁঝালো গন্ধের তরল ছিটিয়ে
আর ইনজেকশনের সূঁচ বিঁধিয়ে
পরাস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
সে শুধু দোষ দেয় নিজের ভাগ্যকে,
আর সর্বশক্তিমানের কাছে বলে
"আমি স্কুল যেতে চাই!"
অতিমারি- বিধ্বস্ত পৃথিবীর আকাশে বাতাসে
ধ্বনিত হয় হাজার-হাজার
লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি শিশু কিশোরের ক্রন্দন —
"আমি স্কুল যেতে চাই!"
(জানুয়ারি ২০২২)
_________
বসন্তের এক মায়াময় দুপুর ছিল সেটা,
সূর্য অকাতরে ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার সোনালি আশীর্বাদ,
দখিনা বাতাস হাত ধরাধরি করে নাচছিল
রঙিন ফুল আর কচি সবুজ পাতার সাথে,
সূর্য অকাতরে ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার সোনালি আশীর্বাদ,
দখিনা বাতাস হাত ধরাধরি করে নাচছিল
রঙিন ফুল আর কচি সবুজ পাতার সাথে,
আর পাঁচটি দিনের মতো সেদিনও সে
হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসেছিল সেখান থেকে,
শুধু না জেনেই —
সে আর কখনও সেখানে ফিরবে না।
পরের দিনের জন্য পরিকল্পনা করতেই মগ্ন ছিল সে,
শুধু না জেনেই —
পরের দিনটি আর কখনও আসবে না।
একটি দিন চলে যায় আরেকটি দিনের পরে।
হিসাব গোনা হয় —
এক মাস লকডাউন,
দুই মাস নাইট কার্ফু,
তিন মাস নিয়ন্ত্রিত যান চলাচল,
চার মাস সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ —
এক মাস লকডাউন,
দুই মাস নাইট কার্ফু,
তিন মাস নিয়ন্ত্রিত যান চলাচল,
চার মাস সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ —
শুধু হিসাব থাকে না,
কয় ফোঁটা চোখের জল
যোগ হল হতাশার সাগরে
কটি কণ্ঠের হাহাকার
বিলীন হল যন্ত্রণার মহাশূন্যে —
দিগন্ত বিস্তৃত নীল মেঘ যখন
ছায়া ফেলে শ্যামলা পৃথিবীর ওপর,
আর কাজলকালো আকাশের বুক চিরে
ঝলসে ওঠে উজ্জ্বল রূপোলি রেখা —
না, মেঘাচ্ছন্ন আকাশে নয়,
তার বুকের মধ্যে যন্ত্রণার সাদা ছুরিতে
ঝলসে ওঠে কটি কথা
"আমি স্কুল যেতে চাই" —
অস্তগামী সূর্যের সোনালি আলো যখন
এসে পড়ে অনলাইন ক্লাসে মগ্ন তার পিঠে,
তখন দূর আকাশের কোণে সবার চোখের আড়ালে
ফুটে ওঠে রক্ত আর চোখের জলে গড়া কটি কথা
"আমি স্কুল যেতে চাই" —
হয়তো কখনো ঈশ্বরের চোখে পড়েছিল সে কথা,
তাই তা একদিন সত্যি হয়েছে,
পূরণ হয়েছে তার ইচ্ছা,
আবার দরজা খুলেছে তার স্বপ্নের দেশের,
হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আবার
হাসতে হাসতে পাড়ি দিয়েছে সেখানে,
শুধু —
তার স্থান নেই সেই সপ্তম স্বর্গে।
যে পৃথিবীর জন্য সে চোখের জল ফেলেছে এতদিন,
প্রার্থনা করেছে সর্বশক্তিমানের কাছে,
সে পৃথিবীর স্বপ্ন যখন সত্যি হল,
সে আর ফিরে যেতে পারল না সেখানে।
তবু বুকের মধ্যে ধরা থাকে একটুকরো স্বর্গ,
সেখানে চকের গুঁড়োয় সাজানো ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে
বসে থাকা ছেলেমেয়েদের প্রাণে
সূর্যের আলোয় সোনার কাঠি স্বপ্ন জাগায়,
আর মুক্ত বাতাস স্নেহের স্পর্শ বুলোয়।
থাক,
তাদের স্থান হোক হৃদয়ের গভীরে,
প্রাণের মাঝেই লালিত হোক তারা,
বাস্তবের কঠিন মাটিতে যারা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
(ফেব্রুয়ারি ২০২২)
_________
সেই কোন এক কুয়াশাভেজা শীতের সকালে
যে মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিল তোমার দ্বারে,
তাকে তুমি আপন করে নিয়েছিলে দু হাত বাড়িয়ে,
আর দায়িত্ব নিয়েছিলে তার শৈশব-কৈশোরকে
আশা-হতাশা, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতার
যুগপৎ কঠোরতা ও কোমলতার পরশে গড়ে তোলার —
যে মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিল তোমার দ্বারে,
তাকে তুমি আপন করে নিয়েছিলে দু হাত বাড়িয়ে,
আর দায়িত্ব নিয়েছিলে তার শৈশব-কৈশোরকে
আশা-হতাশা, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতার
যুগপৎ কঠোরতা ও কোমলতার পরশে গড়ে তোলার —
কোথা দিয়ে চলে যায় একের পর এক বছরগুলো।
একরাশ হাসি আর চোখের জলে তুমি
ভরিয়ে দিয়েছিলে যে বছরগুলোকে
তারা একের পর এক হারিয়ে যায় বাস্তবের কঠিন পাতা থেকে
ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও
চির উজ্জ্বল তারা হয়ে যায় স্মৃতির আকাশে।
তুমি তাকে গড়ে তুলেছো ক্রমে ক্রমে,
তিলে তিলে তাকে প্রস্তুত করেছো জীবন সংগ্রামের জন্য,
হতাশার গভীরে ডুবে যাওয়া তাকে
ফিরিয়ে এনেছো সাফল্যের পথে,
জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে মৃত্যুকে কামনা করা তাকে
দিয়েছো প্রাণময় জগতের স্বাদ —
তাই সে নিজের অতিরিক্ত বই তুলে দেয় দরিদ্র বন্ধুটির হাতে,
প্রতিদান পাবার বিন্দুমাত্র আশা নেই জেনেও
সহপাঠীদের সাহায্য করতে কার্পণ্য করে না,
তাই সে জীবনে প্রথমবার নব্বই শত নম্বর পেয়েও
ভুল উত্তরে পড়া নম্বরটিকে
বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না —
তাই সে অনাবিল আনন্দ খুঁজে পায়
তার নিজের কারণে অন্যের মুখে ফুটে ওঠা হাসিটির মধ্যে,
পরীক্ষায় প্রথম হতে না পেরেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে
যখন দেখে জ্ঞান তার অস্বচ্ছ অসম্পূর্ণ নয়,
তাই সে চরম পরিতৃপ্তির সন্ধান পায়
সবার সাথে হাত মিলিয়ে লব্ধ ক্ষুদ্র সাফল্যটুকুতে —
যে তুমি তাকে শিখিয়েছিলে শত আঘাতেও লক্ষ্যে অনড় থাকতে,
একরাশ যন্ত্রণার মাঝেও হাসিটুকুকে হারাতে না দিতে,
যে তুমি তার কাছে ধরা দিয়েছিলে
সমগ্র মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে,
এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থের মধ্যে কী ক্ষমতা ছিল
সেই তোমাকে তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার ?
যে ভেঙে পড়ত তোমার সামান্যতম কাজে অংশ নিতে না পেরে,
যে তোমার এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যেতেও
চোখের জলে বুক ভাসাত,
কোন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতায় তুমি
তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে তোমার বুক থেকে
কেবল এক অদৃশ্য আণবিক বস্তুর জন্য ?
আজ যখন তার সহপাঠীরা
কেবল সাফল্যের সিড়িতে উত্তরণ নিয়েই উদ্বিগ্ন,
তখন হয়তো একমাত্র সে-ই ফিরে জানিয়েছে তোমার দিকে
দেখো, সে আজও বুকে আঁকড়ে আছে
তোমার উপহার দেওয়া এক স্বর্ণময় জীবনের স্মৃতি
যা এখনও তাকে রক্তাক্ত করে এক অব্যক্ত বেদনায়।
তুমি যদি না পারো তার কাছে
সেই সোনালি স্বপ্নভূমি হয়ে ফিরতে,
তবে সেই পরীক্ষায় কম নম্বর, সবার সামনে কান ধরে দাঁড়ানোর
আনন্দ উৎসবে বঞ্চিত হবার দিনগুলিই দাও ফিরিয়ে
তবু দাও, কিছু দাও,
এভাবে উপেক্ষা করে থেকো না তাকে।
প্রতি বছর একরাশ সাফল্যের উজ্জ্বল প্লাবনে
সেই ব্যর্থ, পরাজিত মেয়েটির ক্রন্দন ডুবে যায়,
তবু তার কাছে স্বর্গ হয়ে থাকে
তোমার ধুলোমাখা বেঞ্চ আর চকমাখা ব্ল্যাকবোর্ড,
যে কিছুই দিতে পারেনি তোমাকে
একবুক নির্জলা ভালোবাসা ছাড়া।
পৃথিবীর কাছে আজ ডিগ্রীধারী সাফল্য বড় গুরুত্বপূর্ণ,
তাই সে তলিয়ে যায় বিস্মৃতির আঁধারে,
কিন্তু যদিবা তুমি তাকে ভুলতে পারো
তুমি কখনো হারিয়ে যাও না তার কাছে,
তার রক্তাক্ত যন্ত্রণাদগ্ধ বুকের মাঝে
স্বর্গীয় আলোয় অনন্তকাল জ্বলজ্বল করে "স্কুল"!
(এপ্রিল ২০২২)
_________
বসুধার বুকে অরুণ আলোকে পুষ্পিত শতদল
দিব্যলোকের কিরণে সিক্ত স্নিগ্ধ সুশ্যামল,
শীর্ষে যাহার জ্ঞানের মুকুট, অঙ্গে স্নেহবলয়
সেই আমাদের স্বপ্নতীর্থ, মোদের বিদ্যালয়।
দিব্যলোকের কিরণে সিক্ত স্নিগ্ধ সুশ্যামল,
শীর্ষে যাহার জ্ঞানের মুকুট, অঙ্গে স্নেহবলয়
সেই আমাদের স্বপ্নতীর্থ, মোদের বিদ্যালয়।
মহাবিশ্বের সুধা যেথায় বিমূর্ত রূপ ধরে
লক্ষ জগৎ আলোয় মিলায় এক হতে একাকারে
দীর্ঘ নিশার আঁধার ঘুচায় রবির অভ্যুদয়,
সেই আমাদের স্বপ্নতীর্থ, মোদের বিদ্যালয়।
চির আলোকিত বিদ্যালোকের অনন্ত কিরণে
প্রাণ হতে প্রাণ সিঞ্চিছ তব স্বর্গীয় অঙ্গনে,
হরষে-বিষাদে কঠিনে-কোমলে কত শত নব প্রাণ
ভাঙিয়া আবার গড়িয়া করিলে চির সুন্দর অম্লান —
স্বপ্ন তরঙ্গে হানিলে আঘাত নিদ্রিত অন্তরে
বহ্নিশিখায় দূরিয়া দুর্বলতার অন্ধকারে,
অন্বেষি যত অন্তরলিপি স্নিগ্ধ মধুর দিশে
সুপ্ত অঙ্কুরে বিকশিলে তুমি ফুলে ফলে স্নেহাশিসে।
জীবনের পথে করিলে ন্যায় ও সত্যে বলীয়ান,
শত আঁধারের মাঝে উজ্জ্বল সুদৃঢ় অটল প্রাণ,
শিখাইলে জ্ঞানের আলোকে দূরিতে হিংসা, দ্বেষ, ও গ্লানি,
কলুষ নাশিতে, হাসি ফুটাইতে, বিলাইতে প্রেমের বাণী।
পথহারা কত অভাগীরে তব কোলে দিলে আশ্রয়,
কঠোর আঘাতে চূর্ণিলে কত জীর্ণ মলিনতায়,
আশাতীত কত স্বপনের পথে করিলে আলোকচারী
দানিলে জীবন, মৃত্যু-করাল গ্রাস হতে উদ্ধারি —
নিজ ছায়াতলে শুকাইলে কত বেদনা-অশ্রুজল,
আশা-অমৃতে ভরিয়া তুলিলে শূন্য হৃৎকমল,
নিঃস্ব অক্ষি নির্ভয়ে চায় সুদূর আলোর পানে
শত বরষের সঞ্চিত ব্যথা বিকাশে শক্তিবাণে।
মারণ অণুর সন্ত্রাসকালে উন্নত করি শির
প্রসারিলে বাহু আলোকদীপ্ত বিদ্যা-মহাদ্রির,
রক্ষিলে তব সন্তানদিগে মহৌষধে! তব রণ
হেরি লজ্জিত অতিমারি আজ করিয়াছে পলায়ন।
সে শকতি আজ উঠুক জ্বলিয়া, এই বিষাদের ক্ষণে!
চিরতরে দাও স্থান তব ওই অমৃত চরণে
স্তব্ধ করিয়া নিঠুর নিদয় অমোঘ সময়স্রোতে!
বিদায়বেলার ছায়া যেন কভু না পড়ে এ স্বপ্নপ্রাতে —
জানি, তবু মেঘ আসিয়া ঝরাবে বিরহ-বেদন-ধারা;
তারপর তব প্রাঙ্গণ আলো করিবে লক্ষ তারা,
শুধু সে আলোর অতলে হারাবে একটি আকুল প্রাণ
নির্জলা ভালোবাসা ছাড়া কিছু পারেনি যে দিতে দান।
তবু জেনো, তব অটল আসন যুগ-যুগান্ত ধরে
সেই স্থানে, যারে পাষাণ সময় গ্রাসিতে কভু না পারে —
হৃদয় গহীনে চির উজ্জ্বল অনন্ত আলোয় তুমি
বিদ্যামৃত-নিকেতন! মম স্বর্গ, স্বপ্নভূমি!
(জুলাই ২০২৩)
_________
নির্দয় বাস্তবের ক্ষমাহীন নিয়ম আজ
যে উচ্চতায় হিঁচড়ে উঠিয়েছে আমাকে
সে দুঃসহ স্তম্ভের উপর থেকে
সপাটে সজোরে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলো —
যে উচ্চতায় হিঁচড়ে উঠিয়েছে আমাকে
সে দুঃসহ স্তম্ভের উপর থেকে
সপাটে সজোরে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলো —
ঝরা শুষ্ক নিঃশেষিত বিবর্ণ পাতার মতো
লুটিয়ে যাব তোমার প্রাঙ্গণে পুষ্পশয্যা মাঝে,
ধুলো থেকে ধুলো হয়ে মিশে যাবে ধুলোয়
আমার প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি, তৃপ্তি- অতৃপ্তি, পূর্ণতা- শূন্যতার সকল হিসেব —
তারপর সেই বাস্তবতার ক্লেদ- কলুষ- মলিনতার ছাই থেকে
আবার গড়ে তোলো তোমার ছায়ায় পাপড়ি মেলা সেই কুঁড়িটিকে,
তোমার স্নেহের পরশে তার চোখে এঁকে দাও
বিশ্বের নিষ্পাপ বিস্ময়ের স্বপ্নের আবেশ —
এক ক্ষতবিক্ষত নিঃশেষিত যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের ভস্মসমাধি থেকে
আবার ফুটে উঠব তোমার অঙ্গনে তোমার ভূমিকন্যা হয়ে,
অবলোকন করব তোমার দিব্য মহিমময়ী বিভা
সেই প্রথম সকালের উন্মীলিত চোখে।
তোমার উচ্চতম চূড়া হোক আমার একমাত্র শিখর
তোমার সুবিশাল বিস্তৃতি হোক আমার একমাত্র বিশালতা
তোমার অঙ্গন হোক আমার একমাত্র জগৎ
তোমার প্রজ্জ্বলিত দিব্যবিভা হোক আমার একমাত্র আলো।
আর কারো নয়, শুধু তোমার, তোমারই —
তোমারই শিষ্যা, তোমারই মানসকন্যা করে ধরে রাখো
তোমার এ স্বর্গলোকে অমৃত বাহুডোরে
জন্মজন্মান্তরের কালহীন শাশ্বত স্বপ্নে।
(সেপ্টেম্বর ২০২৩)
_________
একদা সাজাতে চেয়েছিলে মোরে স্বর্গ- ফুলের মালায়,
চিনিনি তখন, ফিরিয়েছি মুখ অনাদরে অবহেলায়,
মেতেছি রঙিন নেশায়, ভুলেছি মিথ্যে প্রলোভনে!
তাই কি দিতেছ সরিয়ে আজিকে নিদারুণ অভিমানে?
নাহি অধিকার, জানি, তবু আজ সকল লজ্জা ছেড়ে
মন চায়, তব অঙ্গন মাঝে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে
তব অমৃত চরণের তলে দিই সঁপে এই প্রাণ!
হয়ে যাক ম্লান যত নিষ্ফল সফলতা, সম্মান!
নিজের বুকের রক্তে জ্বালিয়ে আশাহীন আশা- বাতি
বৃথাই চেয়েছি পার হতে কত বেদনা- নিবিড় রাতি,
দিব্যবিভার ঝর্ণায় যবে সিক্ত করেছ প্রাণ,
আঁধার ভুলেছি, পিয়েছি তোমার অমৃত- জ্যোতির দান!
ক্লান্ত নিশীথে একাকী আঁধারে নিষ্ফল ফল- ডালি
সাজিয়েছি নিজ বেদনার দানে, নীরবে অশ্রু ফেলি,
যে রাত্রে তব বাহুডোর মাঝে নিয়েছ আমারে টেনে
শত চন্দ্রের ঘুম টুটে ধরা ভেসেছে আলোর বানে।
আর সব রাত ফুরোলে, ফুটেছে উদয়- রক্তলেখায়
অনিশ্চিতের আগমন বাণী ধূসর মেঘের গায়,
যে প্রাতে নূতন অরুণের আলো ভরেছে কনক- কিরণে
নিজেরে পেয়েছি তব ছায়াতলে, তব স্বপ্নাঙ্গনে।
এনেছ ছিনিয়ে মৃত্যুর মুঠি হতে এ শাপিত প্রাণে,
আশিস- পরশে জাগিয়েছ ব্যথা-শলাকারে শক্তিবাণে,
আলোকদাত্রী মহিয়সী অয়ি! তবুও চিনিনি তোমা!
আজ কেন বৃথা অশ্রুর স্রোতে খুঁজি অক্ষম ক্ষমা?
অস্তপটের সূর্য যেদিন লুকিয়েছে মেঘ- মাঝে,
দিক- দিগন্ত সঘন আঁধারে ঢেকেছে অকাল সাঁঝে,
সেইদিন নিদ্ ভেঙেছে, দেখেছি, শত আলো- মণিহারে
জাগিছ আলোকবর্তিকা হয়ে জীবন সাগর- পারে!
এ স্বর্গ ছাড়ি কোথা যাব আমি, কোথা পাব এত আলো!
আর কোথা এত স্বর্ণের স্রোত ধুয়ে দেবে মোর কালো!
জানি, এ বিলাপ বিফল, তবু এ ব্যথার আগুন যেন
তব সুধাশিস মোর প্রাণে রাখে বজ্রের প্রভা- হেন।
যবে দূর নভে তারা হয়ে জাগি, যেন দেখি সেই দিন
উজ্জ্বল হয়ে ভাতিছ লক্ষ তমসারে করি ক্ষীণ
আদি অনন্ত স্বর্গপ্রভার শাশ্বত শিখা বহি
স্বপ্নলোকের আলোময়ী! মম অমৃত দেবী অয়ি!
(অক্টোবর ২০২৩)
© All rights reserved.
Just fire 🔥🔥🔥🔥
ReplyDeleteThank you so much!! 😊😊
Delete